পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব তথা মানব সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার জন্য তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ছাড়া আরও অনেক কারণ রয়েছে। তাদের মধ্যে গামা রে বার্স্ট (Gamma Ray Burst) হল অন্যতম। অতিরিক্ত গ্রহাণুর আঘাতে জীবনধারণের অনুকূল
পরিবেশ নষ্ট হয়ে বিলুপ্ত হয়েছে অতিকায় ডায়নোসরের মতো প্রাণীরা। কিন্তু বর্তমান
পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাত প্রাণের অস্তিত্ব বিলুপ্তিতে হয়তো খুব বেশি প্রভাব রাখতে
পারবে না। কোনো গ্রহাণু ধেয়ে আসলে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি দিয়ে সেটা হয়তো প্রতিরোধ
করা যাবে। কিন্তু বড় ধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরণের মতো ঘটনা মানব সভ্যতাকে একেবারে
ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মানুষ নিজের প্রতি হয়তো অতটা রূঢ় হবে
না। এতটা আত্মঘাতী কাজ মানুষের বিবেকই থামিয়ে দেবে।
কিন্তু মহাকাশ থেকে এমন কোনো আঘাত আসতে পারে যার কারণে পৃথিবীর
প্রতিটি প্রাণীই বিলুপ্ত হতে পারে। মানুষ শত চেষ্টা করেও সেই আঘাত রুখতে পারবে না।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন, আগামীতে পৃথিবীতে মানুষসহ
অন্যান্য প্রাণীর বিলুপ্তির কারণ হবে জিআরবি বা গামা রে বার্স্ট। তাদের দাবি,
গামা রে বার্স্ট আলোর বেগে আসে বলে বুঝতেও পারা যাবে না সেটি কখন
আঘাত হানছে। কেবল আঘাত হানার ধাক্কা খাওয়ার পরে তার প্রভাব দেখে বুঝতে পারা যাবে
যে এটা কতটা ভয়ঙ্কর।
কি এই গামা রে বার্স্ট?
গামা রশ্মি হল উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বা ফোটন কণা। এর শক্তি দৃশ্যমান আলোর চেয়ে অন্তত ৫০ হাজার গুণ বেশী হতে পারে। সেজন্য এটি DNA কে আঘাত করে অনায়াসে ভেঙ্গে দিতে পারে। অনেকটা বন্দুকের গুলি শরীরে লাগার মত।
পৃথিবীর চারপাশে যে ওজোন স্তর রয়েছে তা ক্ষতিকারক মহাজাগতিক রশ্মিকে আটকে দেয়। কিন্তু গামা রশ্মি এই স্তর ভেদ করতে পারে; যার ফল ভয়াবহ। এর ফলে ওজোন স্তর পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে। কীভাবে ধ্বংস হতে পারে একটু দেখা যাক।
গামা রশ্মি অক্সিজেন (O2) ও নাইটোজেন (N2) অণু ভেঙ্গে নাইট্রিক অক্সাইড (NO) এবং নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে (NO2)। NO আবার ওজোন (O3) সাথে বিক্রিয়া
করে NO2 তৈরি করে। এর প্রভাব কয়েক বছর থাকতে পারে। যাই হোক, NO2 আবার দৃশ্যমান
আলোক রশ্মি শোষণ করতে পারে। ফলে গোটা পৃথিবী জুড়ে পর্যাপ্ত সূর্যালোকের অভাবে তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে। শুরু হতে পারে তুষার যুগ।
গামা রে বার্স্ট প্রথম নজরে আসার গল্পটাও মজার।
সময়টা ১৯৬০ এর পরে। আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে ভীষণ ঠান্ডা লড়াই চলছিল সেসময়। আমেরিকা সন্দেহ করে রাশিয়া হয়তো পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সন্ধিতে স্বাক্ষর করার পরেও পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে পারে। সেই সন্দেহের বশে আমেরিকা ভেলা নামের কয়েকটি উপগ্রহ মহাকাশে পাঠায়। উপগ্রহগুলির কাজ ছিল গামা রশ্মির বিকিরণকে শনাক্ত করা। কারণ পরমাণু বিস্ফোরণের ফলে গামা রশ্মির বিকিরণ ঘটে। আর উপগ্রহগুলি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে চাঁদের অপর পৃষ্ঠে যদি কোনো বিস্ফোরণ ঘটে তাও ধরতে পারবে। আর সত্যি সত্যিই গামা রশ্মির বিকিরণ ধরা পড়ল। কিন্তু সেটা পৃথিবী থেকে আসেনি; এসেছে মহাকাশ থেকে। আর শুধু একটা দুটো নয়; পনেরটার মত এরকম ঘটনা ধরা পড়ে।
২০০৮ সালের সালের মার্চ মাসে একটি গামা রে বার্স্ট ধরা পরে যেটির উৎপত্তি ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে ছিল অর্থাৎ দৃশ্যমান মহাবিশ্বের (Observable Universe) অর্ধেক দূরত্ব। এত বিশাল দূর ভেবেই অনুমান করা সম্ভব বিস্ফোরণটি কতটা শক্তিশালী ছিল। সূর্য তার ১০০০ কোটি বছরের জীবনকালে যে
পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে
একটি গামা রে বার্স্ট মাত্র এক
সেকেন্ডে তার
থেকেও বেশি শক্তি তৈরি করে।
গামা রে বার্স্ট সৃষ্টি হয় কীভাবে?
বিগ ব্যাং এর পরে এটিই হল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মহাজাগতিক ঘটনা। গামা রে বার্স্ট দুই ভাবে হতে পারে। (i) যখন দুটি নিউট্রন তারা একে অপরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক মুহুর্তে জুড়ে গিয়ে তৈরি করে একটি ব্ল্যাক হোল। এর ফলে যে মহাবিস্ফোরণ সৃষ্টি হয় তাকে গামা রে বার্স্ট বলে। এই ধরনের GRB কে Long GRB বলা হয়। (ii) আবার সূর্যের চেয়ে ৮ গুণ ও তার বেশি ভারি তারা মহাবিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরি করলে গামা রে বার্স্ট তৈরি করতে পারে। এই ধরনের GRB কে Short GRB বলা হয়।
এখন ব্ল্যাক হোলের মধ্যে একসাথে যখন অনেক গ্যাস প্রবেশ করে তখন এর অক্ষ বরাবর দুই দিক দিয়ে প্রচন্ড বেগে গামা রশ্মি লেজারের মত বের হয়। তাই তো কয়েকশো কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকেও এর অস্তিত্ব জানা যায়।
গড় হিসাব করে দেখা গেছে প্রতিদিন একটা করে GRB হয়েই থাকে। কিন্তু এদের বেশিরভাগটাই ক্ষতিকারক নয়। কারণ এগুলি অনেক দূরের।
তাওলে প্রশ্ন আসে, কত দূরে থাকলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে?
১০০০ আলোক বর্ষের মধ্যে যদি কোনো GRB হয়ে থাকে এবং এর গতিপথের সামনে যদি পৃথিবী থাকে তাহলে পৃথিবীর সামনের অংশটা পুরে যাবে।
এর আগে কি কখনও GRB পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল?
বিজ্ঞানীদের অনুমান ৪৪০ কোটি বছর আগে একবার হয়ে থাকতে পারে। সেই সময় হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। যদিও পৃথিবীর পরিবেশ সে সময় গরম থাকার কথা। মনে করা হয়, GRB আঘাতের
কারণের এটা হয়েছে। এর জন্য প্রায় ৮৫% সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হয়ে গিয়েছল। ঘটনাটিকে Ordovician–Silurian extinction নামে অভিহিত
করা হয়।
৮০০০ আলোকবর্ষ দূরে WR104 নামে একটি মৃত্যুপথগামী লাল তারা রয়েছে। যার ঘূর্ণন অক্ষ পৃথিবীর দিকেই তাক করে আছে। যদি এই মুহুর্তে ওই তারা থেকে GRB ধেয়ে আসে পৃথিবীতে আবার প্রাণের ধ্বংসলীলা শুরু হবে। তবে আসা করা যায় WR104 এ GRB সৃষ্টি হলে পৃথিবী ততদিনে milkyway এর অন্য কোনো প্রান্তে চলে যাবে।
![]() |
| WR-104 |
WR-104 নামের মৃতপ্রায় তারা যেকোনো সময় আমাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
এটা ঠিক যে GRB হল মহাকাশ থেকে আগত একটি প্রাণঘাতী অস্ত্র। তাই বলে এটি সব কিছুর শেষ তা বলা ভুল হবে। কারণ, একটা বৃহৎ তারা ধ্বংসের অবশেষ থেকেই কিন্তু আমাদের সৌরজগতের সৃষ্টি। তাই বলা যায় GRB নতুন তারার জগৎ সৃষ্টির খবর জানিয়ে দেয়।


No comments
Post a Comment