নতুন অবস্থায় যখন পৃথিবী ঘনীভূত হয়েছিল, তখন এর উত্তাপ ছিল খুব বেশি, ছিল না কোনাে বায়ুমণ্ডল । আস্তে আস্তে এটি ঠাণ্ডা হলাে। বিভিন্ন পাথর থেকে নির্গত গ্যাস গড়ে তুলল বায়ুমণ্ডল । প্রাথমিক এই বায়ুমণ্ডল নিয়ে আমরা কিন্তু বাঁচতে পারতাম না। এতে কোনাে অক্সিজেন ছিল না। তবে এতে অন্য গ্যাস ঠিকই ছিল, কিন্তু তা ছিল বিষাক্ত। যেমন, এতে ছিল হাইড্রোজেন সালফাইড (পচা ডিমে এই গ্যাস থাকার কারণেই তা গন্ধ ছড়ায়)। তবে প্রাণের কিছু আদি রূপ এই পরিবেশেও টিকতে পারত।
ধারণা করা হয় এদের উৎপত্তি সাগরে । দৈব প্রক্রিয়ায় পরমাণু থেকে এদের বড় কাঠামাে বা বড় অণু (macromolecule) তৈরি হয়। এটিও আবার অন্য পরমাণুকে যুক্ত করে একই ধরনের কাঠামাে গঠন করে। এতে পুনরুৎপাদিত হতে হতে সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে পুনরুৎপাদনের সময় থেকে যায় ক্রটি। এই ত্রুটিগুলাে এমন যে নতুন বড় অণু নিজে নিজে তৈরি হতে না পেরে নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু কিছু ত্রুটি থেকে এমন কিছু বড় অণু তৈরি হতাে, যা আগের চেয়ে ভালােভাবে পুনরুৎপাদিত হতে পারে। এরা একটু সুবিধাজনক জায়গায় থাকায় আগের বড় অণুদের জায়গা দখলে। নিত। এইভাবে বিবর্তনের মাধ্যমে জটিল থেকে জটিলতর স্ব-উৎপাদনশীল প্রাণীর সৃষ্টি হয় । প্রাথমিক যুগের প্রাণীরা হাইড্রোজেন সালফাইডসহ বিভিন্ন পদার্থ গ্রহণ করত এবং অক্সিজেন ছেড়ে দিত । ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলের উপাদান পাল্টাল । উন্নত ধরনের প্রাণী যেমন মাছ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের আবির্ভাব ঘটল। | বিংশ শতকে এসে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যায়। আমরা বুঝতে পারি, বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের স্থান অতি নগণ্য; বুঝতে পারি সময় ও স্থান বক্র ও অবিচ্ছেদ্য; মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এবং এর একটা শুরু আছে ।
মহাবিশ্ব শুরুতে উত্তপ্ত ছিল এবং পরে প্রসারিত হয়ে ধীরে ধীরে শীতল হয়-এই তথ্য আমরা পাই আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব-সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে । আজ পর্যন্ত এর সব অনুমান পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে গেছে, যা এই তত্ত্বের এক বড় বিজয়। কিন্তু গণিত অসীম সংখ্যা নিয়ে কাজ করতে ব্যর্থ । অথচ বিগ ব্যাং থিওরি অনুসারে একসময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব ও স্থান-কালের বক্রতা ছিল অসীম । ফলে মহাবিশ্বের একটি বিন্দুতে গিয়ে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিজেই নিজের অকার্যকরতা ও ব্যর্থতার কথা ঘােষণা করছে। গণিতে এ ধরনের বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। কোনাে তত্ত্ব যখন অসীম ঘনত্ব, বক্রতা ইত্যাদির মতাে সিঙ্গুলারিটির কথা বলে, বুঝতে হবে তত্ত্বে কিছু ভুল আছে। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব একটি আংশিক তত্ত্ব, কারণ মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হয়েছিল এটি আমাদেরকে তা বলতে অক্ষম।
সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ছাড়াও বিংশ শতকে আমরা প্রকৃতি সম্পর্কে আরেকটি আংশিক তত্ত্ব পেয়েছি । এটি হলাে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। খুবই ক্ষুদ্র মাপের জগতের ঘটনাবলি নিয়ে এর কাজ।
বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে আমরা জানি যে মহাবিশ্ব একসময় এত ক্ষুদ্র ছিল যে সেই অবস্থায় এর বড় মাপের গঠন নিয়ে চিন্তা করতে গেলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়াও মাথায় রাখতে হবে। আমরা পরের অধ্যায়ে দেখব যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহাবিশ্বকে পুরােপুরি বুঝতে আমরা এই দুটি তত্ত্বের ওপরই নির্ভর করছি। এই দুটো আংশিক তত্ত্বকে জোড়া লাগিয়ে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নামে একটিমাত্র তত্ত্ব তৈরি করতে হবে। এতে বিজ্ঞানের সাধারণ সব সূত্র সর্বত্র কাজ করবে, এমনকি সময়ের শুরুতেও । কোনাে সিঙ্গুলারিটির প্রয়ােজন হবে না ।
অনুবাদকের নােট
১. ভারী বলার অর্থ হচ্ছে এতে প্রােটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রনের সংখ্যা বেড়ে যায় । প্রথমে এক প্রােটনের হাইড্রোজেন থেকে দুই প্রােটনের হিলিয়াম হতে থাকে। পরে আরও বেশি প্রােটনবিশিষ্ট পরমাণুরা গঠিত হয়।
২. সূর্যের কয়েক লাখ থেকে শুরু করে কয়েক বিলিয়ন বা তারও বেশি ভরের ব্ল্যাকহােলদের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহােল বলে । এরা সাধারণত বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকে।
৩. সঙ্কট ব্যাসার্ধ হলাে নক্ষত্রের সেই ব্যাসার্ধ, যাতে পৌছলে এর ঘটনা দিগন্ত নামক অঞ্চল তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ, এটি ব্ল্যাকহোেল হবার জন্য তৈরি হয়।
৪. অর্থাৎ, সেই সঙ্কেত আর কোনাে দিনই পাওয়া যাবে না, কারণ ততক্ষণে নক্ষত্রটি ব্ল্যাক হয়ে গেছে এবং কিছুই আর এখান থেকে বের হবে না।
No comments
Post a Comment