আলাের চলাচল সম্পর্কে প্রকৃত তত্ত্ব পেতে তবু ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত
অপেক্ষা করতে হয়। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল কিছু
বিচ্ছিন্ন তত্ত্বকে জোড়া দিতে সক্ষম হলেন। এই তত্ত্বগুলাে সেই সময় পর্যন্ত তড়িৎ ও চৌম্বক বলের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হতাে। প্রাচীনকাল থেকেই তড়িৎ ও চৌম্বক বলের সাথে মানুষের পরিচয় থাকলেও মাত্র অষ্টাদশ শতকে এসে
ব্রিটিশ রসায়নবিদ হেনরি ক্যাভেন্ডিশ ও ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস কুলম্ব দুটো চার্জিত বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল তড়িৎ বল
পরিমাপ করার সূত্র তৈরি করেন। কয়েক দশক পর ঊনবিংশ শতকের শুরুতে কয়েকজন
পদার্থবিজ্ঞানী চৌম্বক বলের জন্যও অনুরূপ সূত্র বানিয়ে ফেলেন। ম্যাক্সওয়েল
গাণিতিকভাবে দেখালেন যে কণিকাদের সরাসরি পারস্পরিক ক্রিয়ার কারণে এই তড়িৎ ও চৌম্বক বলের সৃষ্টি হয় না; বরং প্রতিটি তড়িৎ আধান
(চার্জ) ও প্রবাহ (কারেন্ট)-এর চারপাশের অঞ্চলে একটি ক্ষেত্র (Field) তৈরি করে । এই
ক্ষেত্ৰই নিকটস্থ অন্য সব আধান ও প্রবাহের ওপর বল প্রয়ােগ করে। তিনি দেখলেন যে
একটিমাত্র ক্ষেত্রই তড়িৎ ও চৌম্বক বল বহন করে। অর্থাৎ, তড়িৎ ও চৌম্বক বল আসলে একই বলের অবিচ্ছদ্য রূপ। তিনি এর নাম দিলেন
তড়িচ্চুম্বকীয় বল (Electromagnetic force)। আর বল বহনকারী ক্ষেত্রটির নাম দিলেন
তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে পূর্বাভাস পাওয়া গেল, তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে
তরঙ্গের মতাে উত্তেজনা (disturbance) দেখা যেতে পারে । এ ছাড়াও এই তরঙ্গ চলবে একটি নির্দিষ্ট গতিতে, অনেকটা পুকুরে সৃষ্ট ঢেউয়ের মতাে। এই
গতি পরিমাপ করে তিনি দেখলেন, এর মান হচ্ছে। আলাের বেগের সমান! আজকে আমরা জানি, ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য
৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানােমিটারের মধ্যে থাকলে তা আমাদের চোখে দৃশ্যমান আলাে হিসেবে ধরা
দেয় । (ক্রমান্বয়ে চূড়া ও খাজ তৈরি হওয়াকে বলে তরঙ্গ, আর চুড়া ও খাজগুলাের মধ্যবর্তী
দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে) যেসব তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলাের
তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম তাদেরকে অতিবেগুনি, এক্স-রে এবং গামা রশ্মি বলে। অন্যদিকে, আরাে বড় দৈর্ঘ্যের তরঙ্গকে বেতার (এক
মিটার বা তার চেয়ে বড়), মাইক্রোওয়েভ (প্রায় এক সেন্টিমিটার) অথবা অবলােহিত বিকিরণ (এক
সেন্টিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম কিন্তু দৃশ্যমান পাল্লার চেয়ে
বড়) বলে ।
চিত্র : তরঙ্গ
পর পর দুটি চূড়া বা খাজের মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে বােঝা গেল, বেতার বা আলােক তরঙ্গ একটি নির্দিষ্ট
গতিতে চলবে । পরম আদর্শ স্থির বস্তু বলতে কিছু নেই--নিউটনের। এই বক্তব্যের সাথে এই
কথাকে ঐকতানে আনা কঠিন হয়ে গেল । কারণ এমন কোনাে আদর্শ না থাকলে একটি বস্তুর গতির
ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারবে না। এটি কেন হয় বুঝতে হলে আবারও মনে করুন আপনি
ট্রেনের মধ্যে পিং-পং খেলছেন। আপনি ট্রেনের সামনের দিকে বলটিকে ছুড়ে দিলেন ।
আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে যদি এর বেগ ঘণ্টায় দশ মাইল হয়, তাহলে আপনি আশা করবেন যে প্ল্যাটফর্মে
দাঁড়ানাে কোনাে পর্যবেক্ষক বলটিকে ঘণ্টায় একশ মাইল বেগে যেতে দেখবে। এর মধ্যে দশ
হচ্ছে ট্রেনের সাপেক্ষে বেগ এবং নব্বই হচ্ছে প্ল্যাটফর্মের সাপেক্ষে ট্রেনের নিজস্ব
বেগ। বলের গতিবেগ আসলে কত, ঘণ্টায় দশ মাইল নাকি একশ মাইল? আপনি একে কার সাপেক্ষে বলবেন-ট্রেনের
নাকি পৃথিবীর? পরম আদর্শ স্থির বস্তু বলে কিছু না থাকলে আপনি বলটির জন্য কোনাে পরম
গতি নির্ধারণ করতে পারবেন না। একইভাবে আপনি কার সাপেক্ষে বলছেন তার
ওপর ভিত্তি করে ঐ একই বলের গতি যেকোনাে কিছু হতে পারে । নিউটনের
তত্ত্ব সত্য হলে একই নীতি মানতে হবে আলােকেও । তাহলে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে আলােক
তরঙ্গের বেগ নির্দিষ্ট থাকার কী অর্থ?
আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, কারাে মত অন্য কারাে সাথে যদি নাও মেলে, তবুও প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত সঠিক
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বকে নিউটনের সূত্রের সাথে সন্ধি করানাের জন্য
ইথার নামক একটি বস্তু কল্পনা করা হলাে। ধরে নেওয়া হলাে যে এটি সব জায়গায়
উপস্থিত । এমনকি এটি আছে শূন্য স্থানেও। বিজ্ঞানীরা এই ইথারের ধারণাকে লুফে নিলেন।
তারা ভাবলেন, যেমনি করে জল তরঙ্গের জন্য পানি বা শব্দ তরঙ্গের জন্য বাতাস দরকার, তেমনি তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির প্রবাহের
জন্যও একটি মাধ্যমের প্রয়ােজন । এই মত অনুসারে, শব্দ তরঙ্গ যেভাবে বাতাস বেয়ে চলে
তেমনি আলােক তরঙ্গ চলে ইথার বেয়ে ।
ফলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে প্রাপ্ত আলাের বেগকে ইথারের সাপেক্ষে
বিবেচনা করতে হবে । ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক আলােকে ভিন্ন বেগে আসতে দেখবে ঠিকই, কিন্তু ইথারের সাপেক্ষে এর বেগ থাকবে
একই ।
এই মতের পরীক্ষা নেওয়া যেত। মনে করুন, একটি উৎস
থেকে আলাে নির্গত হলাে। ইথার তত্ত্ব অনুসারে, আলাে এর নিজস্ব বেগে ইথার ভেদ করে চলে ।
আপনি ইথারের মধ্য দিয়ে আলাের দিকে যেতে থাকলে, আলাের দিকে আপনার গতিবেগ হবে ইথারে
আলাের বেগ ও ইথারে আপনার নিজস্ব বেগের যােগফলের সমান । আপনি স্থির থাকলে বা অন্য
কোনাে দিকে গেলে আলাের বেগ যা হতাে, এ ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি হবে । কিন্তু
আমরা কোনাে আলােক উৎসের দিকে সর্বোচ্চ যে বেগে
যেতে পারি তার তুলনায় আলাের বেগ অনেক বেশি হওয়ায় বেগের এই পার্থক্য পরিমাপ করা
সহজ কাজ ছিল না।


No comments
Post a Comment