নিউটনের গতি সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি বলের প্রভাবে বস্তুর মধ্যে
কী
প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অন্যদিকে নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা
মহাকর্ষ নামক বিশেষ বলটির শক্তি বের করতে জানলাম। আমরা আগেও বলেছি যে এই তত্ত্ব
বলছে, প্রত্যেকটি বস্তু একে অপরকে এদের ভরের সমানুপাতিক একটি বলে আকর্ষণ
করছে। কাজেই, কোনাে একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ করলে এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল বল দ্বিগুণ
হবে। এটা কেন হয় তা সহজেই বােধগম্য ! কারণ নতুন বস্তুটিকে আগের ভরবিশিষ্ট দুটি
ভিন্ন বস্তু মনে করা যেতে পারে । এই দুটি বস্তুই অন্য বস্তুটিকে প্রাথমিক বলে
আকর্ষণ করবে। ফলে নতুন অবস্থায় বস্তুদের আকর্ষণ আগের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। আবার
ধরুন, একটি বস্তুর ভর ছয় গুণ হলাে, অথবা একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ এবং অপরটির
ভর তিন গুণ হলাে, তাহলে তাদের মধ্যকার নতুন বল ছয় গুণ শক্তিশালী হবে।
এবার বােঝা যাচ্ছে, কেন সকল বস্তু একই হারে পড়ে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুসারে দ্বিগুণ
ভরের বস্তু দ্বিগুণ মহাকর্ষ বলে নিচের দিকে পড়বে। কিন্তু ভর দ্বিগুণ হবার কারণে
আবার নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে এতে ত্বরণও হয়ে যাবে অর্ধেক। নিউটনের
সূত্রের এই দুই প্রভাব। একে অপরকে পুরােপুরি বাতিল করে দেয়। ফলে, ভর যাই হােক, ত্বরণ হবে একই।
ভরের সাথে মহাকর্ষের সম্পর্ক হচ্ছে একটি বস্তুর ভর দ্বিগুণ হলে তার
উপর কার্যকরী মহাকর্ষও দ্বিগুণ হবে।
চিত্র : দুইয়ের বেশি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় টান একটি বস্তুর ভর
দ্বিগুণ হয়ে গেলে, এর ওপর ক্রিয়াশীল মহাকর্ষও হবে দ্বিগুণ
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আরও বলছে, বস্তু যত দূরে থাকবে বল হবে তত কম।
সূত্রের বক্তব্য হচ্ছে, কোনাে নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় টান এর অর্ধেক দূরত্বে থাকা একই ভরের
নক্ষত্রের চার ভাগের এক ভাগ হবে । এই সূত্রের মাধ্যমে পৃথিবী, চাঁদ এবং গ্রহদের কক্ষপথের পূর্বাভাস
অনেকটা নির্ভুলভাবে পাওয়া গিয়েছিল। যদি দূরত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে মহাকর্ষের
পরিবর্তন আরেকটু কম বা বেশি হতাে তবে গ্রহদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার (Elliptical) হতে পারত না; হয় এরা সর্পিল পথ বেয়ে সূর্যের দিকে চলে যেত অথবা হারিয়ে যেত
সূর্য থেকে দূরে।
অ্যারিস্টটলের সাথে নিউটন ও গ্যালিলীয় মতের একটি বড়সড় পার্থক্য
আছে। অ্যারিস্টটল স্থির অবস্থাকে বস্তুর মৌলিক ধর্ম মনে করেছিলেন, বলেছিলেন বল বা ঘাত প্রযুক্ত না হলে
বস্তু স্থিরই থাকবে। বিশেষ করে, তিনি পৃথিবীকে স্থির ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিউটনের সূত্র থেকে দেখা
যায় যে নির্দিষ্ট কোনাে বস্তুকে আদর্শ স্থির বলার উপায় নেই। একটি বস্তু ‘ক’ স্থির আছে এবং আরেকটু বস্তু ‘খ’ ‘ক’-এর সাপেক্ষে গতিশীল-এটা যেমন বলা যেতে
পারে, একইভাবে বলা যেতে পারে যে ‘খ' স্থির এবং ‘ক’ ই বরং ‘খ’- এর সাপেক্ষে নির্দিষ্ট বেগে গতিশীল।
যেমন আপনি যদি কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারদিকে আবর্তন এবং সূর্যের
চারদিকে এর ঘূর্ণন গতির কথা ভুলে যান, তাহলে আপনি চাইলে বলতে পারেন যে পৃথিবী
স্থির এবং এর ওপর দিয়ে একটি ট্রেন ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে উত্তর দিকে যাচ্ছে। আবার
চাইলে এটাও বলতে পারেন যে ট্রেনটা স্থির এবং পৃথিবীই ঘণ্টায় ৯০ মাইল বেগে দক্ষিণ
দিকে যাচ্ছে। আপনি গতিশীল বস্তু নিয়ে ট্রেনের মধ্যে কোনাে পরীক্ষা চালালেও
নিউটনের সবগুলাে সূত্র আগের মতােই ঠিকঠাক কাজ করবে। কে ঠিক তাহলে, নিউটন নাকি অ্যারিস্টটল? এবং আপনি তা কীভাবে বুঝবেন?
একটি পরীক্ষা হবে এমন : ধরুন আপনি কোনাে বক্সে আবদ্ধ আছেন এবং আপনি
জানেন না বক্সটি কি কোনাে চলন্ত ট্রেনের মেঝেতে আছে। নাকি নিরেট পৃথিবীর বুকে আছে।
এ ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের মত অনুসারে পৃথিবী হচ্ছে আদর্শ স্থির বস্তু। এখন আসলে
আপনি কোথায় আছেন তা বলার কোনাে উপায় আছে কি?
যদি উপায় থেকে থাকে, তাহলে অ্যারিস্টটল ঠিকই বলেছেন অর্থাৎ
পৃথিবীতে স্থির থাকা একটি বিশেষ ব্যাপার। কিন্তু আপনি যদি চলন্ত ট্রেনে রাখা বক্সে
কোনাে পরীক্ষা চালান তাহলে সেটি ট্রেনের স্থির' প্ল্যাটফর্মে রাখা বক্সের মধ্যে চালানাে
পরীক্ষার মতাে হুবহু একই ফল দেবে। এখানে অবশ্য আমাদেরকে ধরে নিতে হবে ট্রেন চলার
সময় কোনাে ধাক্কা, মােড় বা অন্য কোনাে অস্বাভাবাবিকতা থাকবে না।
ট্রেনের ভেতরে পিন-পং খেললেও দেখা যাবে রেললাইনের পাশের কোনাে টেবিলে
পিংপং খেলার সাথে এর কোনাে পার্থক্য নেই। আপনি যদি বক্সে বসে পৃথিবীর সাপেক্ষে
বিভিন্ন বেগে যেমন ঘণ্টায় শূন্য, পঞ্চাশ ও ৯০ মাইল বেগে গেমটি খেলেন, তাহলে প্রতি ক্ষেত্রেই বল একই আচরণ
করবে। প্রকৃতি এভাবেই কাজ করে আর নিউটনের সূত্রের গাণিতিক দিকও এটাই বলতে চায়।
পৃথিবী গতিশীল নাকি ট্রেন-তা বলার কোনাে উপায় নেই। গতির বিষয়টা অর্থবহ হয়ে ওঠে
তখনই, যখন একে অন্য বস্তুর সাথে তুলনা করা হয়। | অ্যারিস্টটল নাকি নিউটন সঠিক তার সত্যিই
কি কোনাে গুরুত্ব আছে? পার্থক্যটা শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কি
না? বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব কতখানি? সত্যি বলতে, পরম আদর্শ স্থিরবস্তুর অভাব
পদার্থবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর অর্থ হচ্ছে, ভিন্ন সময়ে ঘটা দুটো ঘটনা ঠিক একই
স্থানে ঘটেছে কি না তা আমরা বলতে পারব না।


No comments
Post a Comment