বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব প্রদান করা, যা সমগ্র মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। অবশ্য অধিকাংশ বিজ্ঞানীই বাস্তবে সমস্যাটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কাজ করেন। প্রথমত, কিছু সূত্র আমাদেরকে বলছে যে সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের কীরূপ পরিবর্তন। ঘটছে। (আমরা যদি কোনাে একটি সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা জানি, এই ভৌত সূত্রগুলাে আমাদের বলবে পরবর্তী কোনাে সময়ে মহাবিশ্ব কী অবস্থায়। থাকবে ।) দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলাে মহাবিশ্বের আদি অবস্থা নিয়ে। কেউ কেউ মনে করেন, বিজ্ঞানের উচিত শুধু প্রথম অংশটি নিয়ে কাজ করা। তাঁদের মতে, মহাবিশ্বের আদি অবস্থার বিষয়টি অধিবিদ্যা বা ধর্মের আলােচ্য বিষয়। তাঁদের মতে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহাবিশ্বের সূচনা নিজের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই করেছেন। তা হলেও হতেও পারে । কিন্তু সে ক্ষেত্রে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে কোনাে অনির্দিষ্ট প্রক্রিয়াতেই বিবর্তিত হতে দিতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তিনি একে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন করেছেন, যা কিছু সূত্র। মেনে চলছে। কাজেই মহাবিশ্বের আদি অবস্থাও কিছু নিয়ম মেনে চলছিল মনে করাটাই যুক্তির দাবি।
মহাবিশ্বের সব কিছুকে একই তত্ত্বে গেঁথে ফেলা কঠিন একটি কাজ। ফলে আমরা একে ভেঙে অনেকগুলাে আংশিক তত্ত্ব তৈরি করি। এই আংশিক তত্ত্বদের প্রতিটি কিছু নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও পূর্বাভাস দিতে। পারে। এর আওতার বাইরের বিষয়গুলাে সম্পর্কে এটি নীরব থাকে অথবা। তাদেরকে কিছু সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করে । খুব সম্ভব, এটি একটি ভুল পদ্ধতি। যদি মৌলিক জায়গাটিতে মহাবিশ্বের সব কিছু অন্য সব কিছুর ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে এদেরকে আংশিকভাবে মূল্যায়ন করে পূর্ণাঙ্গ সমাধানে পৌছা সম্ভব নাও হতে পারে । তবুও আমরা অতীতে কিন্তু এটাই করে এসেছি। উদাহরণ হিসেবে আবারও বলব নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের কথা । এটি বলছে, দুটো বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল বস্তুদ্বয়ের একটিমাত্র নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর (ভর) নির্ভরশীল। বস্তু কী দিয়ে তৈরি। তার ওপর এই বল নির্ভর করে না। কাজেই গ্রহদের কক্ষপথের হিসাব বের করার জন্য এদের এবং সূর্যের গঠন ও উপাদানের জন্য আমাদের আলাদা কোনাে তত্ত্বের প্রয়ােজন নেই।
বর্তমানে মহাবিশ্বের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা দুটি মৌলিক আংশিক তত্ত্ব কাজে লাগাচ্ছেন। এরা হলাে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই দুটি তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বুদ্ধির জগতের এক বিরাট অর্জন । সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব মহাকর্ষ বল ও মহাবিশ্বের বড় দৈর্ঘ্যের কাঠামােকে (Large scale structure) ব্যাখ্যা করে। মাত্র কয়েক মাইল থেকে শুরু করে অন্তত এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১-এর পরে ২৪টি শূন্য) মাইল তথা পর্যবেক্ষণযােগ্য মহাবিশ্বের আকারের সমপরিমাণ অংশ এই তত্ত্বের আওতায় আছে। অন্যদিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে এক ইঞ্চির এক লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগের মতাে অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের জগতে। এই দুটি তত্ত্ব আবার একে অপরের বিরােধী-এদের দুটোই যে ঠিক হবে। সেটি সম্ভব নয়। বর্তমানে পদার্থবিদ্যার একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নতুন একটি তত্ত্ব প্রদান করা, যা এই দুটো তত্ত্বকে একীভূত করে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নামে কমন একটি তত্ত্বের জন্ম দেবে। এই তত্ত্ব নিয়ে আলােচনা এই বইয়েরও একটি অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য । আমরা এখনও এমন তত্ত্ব প্রস্তুত করতে পারিনি । হতে পারে, আমরা এখনও এর থেকে বহু দূরে আছি । কিন্তু এই তত্ত্বের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার অনেকগুলােই আমরা ইতােমধ্যে জেনে গেছি । পরের অধ্যায়গুলােতে আমরা দেখব কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি নামক তত্ত্বটিকে কী কী পূর্বাভাস দিতে পারতে হবে তা সম্পর্কে আমরা ইতােমধ্যেই অনেক কিছু জানি ।
বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলাে কাজ করত শুধু দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রগুলােতে। এরপরে এসে পদার্থবিদ্যার পরিধি বিস্তৃত হয়ে পৌছায় মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম চৌহদ্দি পর্যন্ত ।
এখন আমরা যদি বিশ্বাস করি যে মহাবিশ্ব এলােমেলােভাবে নয় বরং চলছে। কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, তাহলে এই আংশিক সূত্রগুলােকে অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্বে রূপদান করতে হবে, যা ব্যাখ্যা দেবে মহাবিশ্বের সব কিছুর । কিন্তু এ রকম একটি একীভূত তত্ত্বের সন্ধানে নামলে একটি সঙ্কটের মুখে পড়তে হয় । ওপরে উল্লিখিত বিজ্ঞানের এই চিন্তা ভাবনাগুলােতে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে আমরা বুদ্ধিমান জীব, যারা স্বাধীনভাবে মহাবিশ্বকে দেখছি ও তা থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যদি এটা সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা উন্নতি করতে করতে একদিন মহাবিশ্বের কার্যকরী নিয়মগুলাের কাছাকাছি পৌছতে পারব বলে মনে করা খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, এমন কোনাে পূর্ণাঙ্গ একীভূত সূত্র যদি থাকেই তবে সেটি নির্ধারণ করবে আমাদের নিজেদের কাজকর্মও । তার মানে তত্ত্ব নিজেই এর অনুসন্ধানের ফলাফল নির্ধারণ করবে। তাহলে সেই তত্ত্ব কেন এটাই নির্ধারণ করবে যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছব? সেটা তাে আমাদের জন্য এটাও নির্ধারণ করে রাখতে পারে যে আমরা ভুল সিদ্ধান্তে পৌছব, তাই না? অথবা এমনও হতে পারে, এটি নির্ধারণ করে রাখবে যে আমরা কোনাে সিদ্ধান্তেই পৌছতে পারব না!
মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য-০২
মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য-০৩
এখন আমরা যদি বিশ্বাস করি যে মহাবিশ্ব এলােমেলােভাবে নয় বরং চলছে। কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, তাহলে এই আংশিক সূত্রগুলােকে অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্বে রূপদান করতে হবে, যা ব্যাখ্যা দেবে মহাবিশ্বের সব কিছুর । কিন্তু এ রকম একটি একীভূত তত্ত্বের সন্ধানে নামলে একটি সঙ্কটের মুখে পড়তে হয় । ওপরে উল্লিখিত বিজ্ঞানের এই চিন্তা ভাবনাগুলােতে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে আমরা বুদ্ধিমান জীব, যারা স্বাধীনভাবে মহাবিশ্বকে দেখছি ও তা থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যদি এটা সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা উন্নতি করতে করতে একদিন মহাবিশ্বের কার্যকরী নিয়মগুলাের কাছাকাছি পৌছতে পারব বলে মনে করা খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, এমন কোনাে পূর্ণাঙ্গ একীভূত সূত্র যদি থাকেই তবে সেটি নির্ধারণ করবে আমাদের নিজেদের কাজকর্মও । তার মানে তত্ত্ব নিজেই এর অনুসন্ধানের ফলাফল নির্ধারণ করবে। তাহলে সেই তত্ত্ব কেন এটাই নির্ধারণ করবে যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছব? সেটা তাে আমাদের জন্য এটাও নির্ধারণ করে রাখতে পারে যে আমরা ভুল সিদ্ধান্তে পৌছব, তাই না? অথবা এমনও হতে পারে, এটি নির্ধারণ করে রাখবে যে আমরা কোনাে সিদ্ধান্তেই পৌছতে পারব না!
আরো পড়ুন...
মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য-০১মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য-০২
মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য-০৩

No comments
Post a Comment