সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের আরেকটি পূর্ভাবাস হলাে, বড় ভরের বস্তুর আশেপাশে সময়কে ধীরে চলতে দেখা যাবে। যেমন পৃথিবীর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটবে। বিষয়টি সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের মাথায় আসে ১৯০৭ সালে । এর পাঁচ বছর পরে তিনি বুঝতে পারেন, মহাকর্ষ স্থানের আকৃতিও বদলে দেয়। আরও তিন বছর পর তিনি তত্ত্বটি সম্পূর্ণ করেন। এই প্রতিক্রিয়া বের করতে তিনি তাঁর সমতুল্যতার নীতি (Principle of equivalence) ব্যবহার করেন। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে আপেক্ষিকতার মৌলিক স্বীকার্য যে ভূমিকা পালন করেছিল, সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে সেই একই ভূমিকা পালন করেছিল এই নীতিটি।
মনে আছে নিশ্চয়, বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যের বক্তব্য ছিল, মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষকের কাছে বিজ্ঞানের সূত্রগুলাে একই থাকবে, বেগ যাই হােক তাতে কিছু আসে যায় না। বলা চলে, সমতুল্যতার নীতি আগের এই স্বীকার্যকে আরেকটু লম্বা করেছে । ফলে এটি এমন পর্যবেক্ষকের জন্যও খাটবে, যিনি মুক্তভাবে গতিশীল নন, কিন্তু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যেই আছেন। এই নীতিকে সংক্ষেপে তুলে ধরতে হলে কিছু পারিভাষিক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন, মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সুষম (সব দিকে একই রকম) নয়। ফলে নীতিটিকে আলাদা আলাদাভাবে অনেকগুলাে ছােট ছােট ও পরস্পরচ্ছেদী অংশে ভাগ করতে হবে। অবশ্য এটা আমরা এখানে করব না। আমাদের উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখে আমরা এই নীতিকে এভাবে বলতে পারি, যথেষ্ট ক্ষুদ্র স্থানের। অঞ্চলে অবস্থান করে এটা বলা সম্ভব নয় যে আপনি কোনাে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থিরাবস্থায় আছেন, নাকি শূন্য স্থানে সুষম হারের ত্বরণ (বেগ বৃদ্ধি) নিয়ে চলছে।
মনে করুন, আপনি মহাশূন্যের মধ্যে এমন একটি লিফটে আছেন, যেখান মহাকর্ষ অনুপস্থিত। ফলে এখানে ওপর বা বা নিচ বলতে কিছু নেই। আপনি মুক্তভাবে ভেসে আছেন। একটু পর লিফটখানা সমত্বরণে চলতে শুরু করল। এখন কিন্তু হঠাৎ করে আপনি ওজন অনুভব করবেন।আপনি লিফটের এক প্রান্তের দিকে একটি টান অনুভব করবেন। এখন এ দিকটিকেই আপনার কাছে মেঝে মনে হবে! আপনি এখন হাত থেকে একটি আপেল ছেড়ে দিলে এটি মেঝের দিকে চলে যাবে। আসলে এখন আপনার মতােই লিফটের ভেতরের সব কিছুর ত্বরণ হচ্ছে।
মনে হচ্ছে লিফটটা আসলে মােটেই গতিশীল নয়, বরং এটি একটি সুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থির অবস্থায় আছে। আইনস্টাইন বুঝতে পারলেন, ট্রেনের ভেতরে বসে যেমনআপনি বলতে পারেন না যে আপনি সম বেগে চলছেন কি, তেমনি লিফটের ভেতরে বসেও আপনি বুঝতে পারবেন না আসলে আপনি। সুষম ত্বরণে চলছেন, নাকি কোনােসুষম মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যে আছেন। আইনস্টাইনের এই চিন্তার ফলাফলই হলাে সমতুল্যতার নীতি।
সমতুল্যতার নীতি এবং এর ওপরের উদাহরণটি সত্য হলে বস্তুর জড় ভর (Inertial mass) ও মহাকর্ষীয় ভরকে (Gravitational mass) অবশ্যই একই জিনিস হতে হবে।বল প্রয়ােগের ফলে কতটুকু ত্বরণ হবে তা নির্ভর করে জড় ভরের ওপর। এই ভর নিয়ে কথাই বলা হয়েছে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রে। আর অন্যদিকে মহাকর্ষীয় ভরের কথা আছে নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রে। আপনি কতটুকু মহাকর্ষীয় বল অনুভব করবেনতা নির্ভর করে এই ভরের ওপর (চতুর্থ অধ্যায় দেখুন)। এই দুটি ভর যদি একই হয়ে থাকে তবেই কেবল কোনাে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে উপস্থিত সকল বস্তু একই হারে পতনশীলহবে এবং সে ক্ষেত্রে এই পতন এদের ভরের ওপর নির্ভর করবে না। আর যদিসমতুল্যতার নীতি সঠিক না হতাে, তাহলে মহাকর্ষের প্রভাবে কিছু বস্তু অন্যদের চেয়ে দ্রুত পতনশীল হতাে। এর অর্থ হলাে, আপনি মহাকর্ষীয় টানের সাথে সুষম ত্বরণের (যেখানে সব কিছু একই হারে পতিত হচ্ছে) পার্থক্য ধরতে পারতেন। জড় ও মহাকর্ষীয়ভরের এই সমতুল্যতা কাজে লাগিয়েই আইনস্টাইন তাঁর সমতুল্যতার নীতি এবং শেষ পর্যন্ত পুরাে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব দাঁড় করান । এর জন্য দরকার ছিল যুক্তির এমন অবিরত চর্চা, যারদ্বিতীয় নজির মানুষের চিন্তার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
No comments
Post a Comment