সময়ের প্রবাহের পার্থক্য ধরা পড়ে আমাদের শরীরেও। এমন এক জোড়া যমজের কথা চিন্তা করুন, যাদের একজন বাস করছে পাহাড়ের চূড়ায় এবং আরেকজন সমুদ্র সমতলে । প্রথমজনের বয়স অপরজনের চেয়ে দ্রুত বাড়বে। দুজনে আবার দেখা করলে দেখবে একজনের বয়স আরেকজনের চেয়ে বেশি। এই ক্ষেত্রে বয়সের পার্থক্য খুব ক্ষুদ্র হবে হবে । তবে এদের একজন যদি আলাের কাছাকাছি গতিতে মহাকাশযানে করে দীর্ঘ ভ্রমণ করে ফিরে আসে তাহলে দেখা যাবে যমজের চেয়ে তার বয়স অনেক বেশি পরিমাণে কম হচ্ছে। একে বলা হয় টুইন প্যারাডক্স। তবে মাথার মধ্যে পরম সময়ের ধারণাকে স্থান দিলে তবেই একে প্যারাডক্স (পরস্পরবিরােধী বা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনা) মনে হবে। আপেক্ষিক তত্ত্বে একক পরম সময় বলতে কিছু নেই। বরং প্রত্যেক দর্শক তাঁর নিজের মতাে করে সময় মাপেন। তাঁর মাপা এই সময় কেমন হবে তা নির্ভর করে তার অবস্থান ও গতির ওপর।
১৯১৫ সালের আগে স্থান ও কালকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল ধরা হতাে, যেখানে কোনাে ঘটনা ঘটে, কিন্তু যা ঘটবে তা এদেরকে (স্থান-কাল) প্রভাবিত করবে না। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও এটা সত্য ছিল। বস্তুরা চলছে, বল আকর্ষণ-বিকর্ষণ করছে, কিন্তু স্থান ও কাল চলছে নির্বিঘ্নেই। সময় ও স্থান অবিরত চলছে এমন ভাবাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে অবস্থা একেবারে ভিন্ন। এখানে স্থান ও কাল হলাে গতিশীল রাশি। একটি বস্তু চললে বা কোনাে বল ক্রিয়াশীল হলে প্রভাবিত হয় স্থান ও কালের বক্রতা । ফলশ্রুতিতে বস্তু কীভাবে চলবে এবং বল কীভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করে স্থান-কালের গঠনের ওপর । মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তাকে স্থান-কাল শুধু প্রভাবিতই করে না, তা দ্বারা নিজেরাও প্রভাবিত হয়। স্থান-কালের ধারণা ছাড়া যেমন আমরা মহাবিশ্বের কোনাে ঘটনা বােঝাতে পারি না, তেমনি সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের সীমানার বাইরের স্থান-কাল নিয়েও আমাদের নাক গলানাে অর্থহীন। ১৯১৫ সালের পরবর্তী দশকগুলােতে স্থান-কালের এই নতুন জ্ঞান মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ভাবনায় বিপ্লব সূচিত করে। আমরা পরে আরও বিস্তারিত দেখব যে আগে মনে করা হতাে মহাবিশ্বে কোনাে পরিবর্তন নেই । এটা যুগ যুগ ধরে বিরাজমান ছিল এবং চিরকাল টিকে থাকবে । এই ভাবনা বদলে গেল । এর স্থানে এল গতিশীল ও সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের ধারণা। এখন মনে হচ্ছে এটি একটি নির্দিষ্ট সময় আগে শুরু হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পরে এর ইতি ঘটবে।
নােট- ১. পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ দুই মেরুর মাঝ বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে কল্পিত রেখাকে ঝিব রেখা বলে। সাধারণ হিসাবে প্রভাব দুটো যে উল্টোভাবে কাজ করে সেটা বলাই উদ্দেশ্য। ২. সমতল মানচিত্রে যে আসলে বক্র পৃথিবীকে সঠিকভাবে দেখানাে সম্ভব নয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যথাসম্ভব অস্ট্রেলিয়া ও গ্রিনল্যান্ডের মানচিত্র দেখা যােঝ যায় । সমতল মানচিত্রে অস্ট্রেলিয়াকে গ্রিনল্যান্ডের চেয়ে অনেক ছােট দেখায়, যদিও আসলে গ্রিনল্যান্ডই অনেক ছােট। এর কারণ হলাে, বক্র পৃথিবীতে গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর উত্তর মেরুর খুব কাছে হওয়ায় এর অঞ্চল অনেক কুঁচকে আছে, যেটা সমতল দ্বিমাত্রিক মানচিত্রে দেখানাে অসম্ভব। ৩. বুঝতে অসুবিধা হলে পরের ছবিতে দেখানাে উদাহরণের সাথে মিলিয়ে পড়ুন। ৪. পৃথিবী প্রায় এক বছরে সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসে। পৃথিবী কক্ষপথের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকার সময় আমরা রাতের আকাশে ভিন্ন ভিন্ন তারার সমাবেশ দেখি । এক বছর পর আবার আগের তারাগুলাে দেখি । প্রত্যেক মাসেই কিছু তারা সূর্যের সাথে সাথে বা একটু আগে বা পরে অস্ত যায় । এরাই পৃথিবীর আকাশে সূর্যের কাছাকাছি থাকে। সূর্যের ভরের কারণে এদের আলাে আমাদের চোখে বক্র পথে এসে দেখা যাওয়ার কথা । যায়ও বটে, তবে এরা যেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ সময় সূর্যের আশপাশে থাকে তাই এই সময় সূর্যের আলাের তেজে এদের নিজস্ব আলাে আর দেখা যায় না। তাহলে দেখার উপায় কী? উত্তর হলাে, সূর্যগ্রহণের সময়। ৫. যেহেতু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মতােই সুষম ত্বরণে চলমান কোনাে সিস্টেম (যেমন ওপরের উদাহরণে লিফটের মধ্যে থাকা সকল বস্তু) একই হারে পতনশীল হচ্ছে, তাদের ভর যাই হােক না কেন, তাই মহাকর্ষ ও সুষম তৃরণের পার্থক্য বলার কোনাে উপায় নেই। এটাই সমতুল্যতার নীতি। ৬. যে গ্রীক্ষা বাস্তবে করা যায় না, চিন্তা করে করে বুঝতে হয়, তাকে থট এক্সপেরিমেন্ট বলে । ৭. অর্থাৎ এর দৈর্ঘ্য ১,৮৬,০০০ মাইল। ৮. বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বে পৃথিবী থেকে দূরে গিয়ে অনেক বেশি বেগে ভ্রমণ করে এলে আপনার বয়স অপেক্ষাকৃত কম হবে। আর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব। অনুসারে, আপনি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে দূরে অবস্থান করলে বয়স দ্রুত বাড়বে। একটি প্রভাব আপাত দৃষ্টিতে আরেকটি থেকে উল্টোভাবে কাজ করে। অবশ্য বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব কার্যকর হবার জন্য আপনাকে রকেটে চড়ে মহাশূন্যেই যেতে হবে এমন কোন কথা নেই । আপনি যদি পৃথিবীতেই একটি অসম্ভব দ্রুতগামী ট্রেনে চড়েও ভ্রমণ করেন তবু ট্রেনের বাইরে থাকা আপনার বন্ধুর চেয়ে আপনার বয়স কম হবে।
No comments
Post a Comment