Responsive Ad Slot

সর্বশেষ

latest

কালো মেঘের আলো...

Tuesday, 19 November 2019

/ by Admin

[১]
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে তখন। বৃষ্টির মৌসুম নয়। অবেলার বৃষ্টি। অবেলার বলেই হয়তোবা বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। যেন অন্ধকারে ভরে গেছে গোটা পৃথিবী।
আমাদের ঘরে টিমটিমে একটি আলো জ্বলছে। মাটির ঘর৷ জানালা দিয়ে সেই আলোর বিচ্ছিন্ন কিছু অংশ দাওয়ায় এসে পড়েছে। সেই আলোতে হাত পা কুঁকড়িয়ে বসে আছি আমরা চারজন। আমি, বড় আপা, রুমু আর মারুফা। আমাদের মধ্যে বড় আপার ছটফটানিটাই সবচেয়ে বেশি। সে একটু পর পর জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঘরের ভেতর। তার চোখেমুখে আশা এবং ভয়ের এক অদ্ভুত সমন্বয়। বড় আপা কেনো ভয় পাচ্ছে সেটা জানিনা। কি নিয়ে এতো আশা করে আছে তা-ও জানিনা। এই ঘন ঘোর বৃষ্টি বাদলের দিনে কেনো আমাদের ঘরের ভিতরে থাকার অনুমতি মিলছে না তা-ও বোধগম্য হচ্ছেনা। রুমু পুতুল খেলায় ব্যস্ত। মারুফার খেলায় মন নেই। সে অপলক আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত কালো মেঘের ছুটোছুটি দেখতে তার ভালো লাগছে।
মা'কে দেখা যাচ্ছেনা। মা মনে হয় কোন কাজে ব্যস্ত আজ। কিন্তু, এমন দূর্যোগের দিনে মা একটিবার আমাদের খোঁজ নেবে না, তা কি করে হয়? মা'র কি তাহলে কোন অসুখ করেছে? বড় কোন অসুখ? যে অসুখ হলে বিছানা ছেড়ে উঠা যায় না?
শব্দ করে কথা বলা যাবেনা আজ। বড় আপার নির্দেশ। একটু আগেই সে আমাদের কড়া চোখে বলে রেখেছে, 'খবরদার! কোন শব্দ করিস নে যেন!'
তার সাবধান বাণীতে আমরা তিনজনই চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু, মা'কে অনেকক্ষণ হয় দেখছিনা। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বড় আপার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, 'মা'র কি অসুখ করেছে আপা?'
সে ফিসফিসিয়ে বললো, 'না'।
- 'তাহলে?'
- 'তাহলে কি?'
- 'মা'কে দেখছিনা যে?'
বড় আপা খানিকক্ষণ চুপ মেরে রইলো। এরপর বললো, 'দেখবি। অপেক্ষা কর'।
হঠাৎ ঘরের দরোজা খুলে গেলো। হনহন করে বেরিয়ে এলো এক বয়স্ক মহিলা। চেহারায় বয়সের আধিক্যের ছাপ। এসেই বড় আপার সাথে ফিসফিসিয়ে কি যেন বললো। বড় আপা এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে কি কতোগুলো জোগাড় করে মহিলার হাতে দিলো। মহিলা সেগুলো নিয়ে আবার হনহন করে ঘরের ভিতরে ঢুকে ধপাস করে দরোজা লাগিয়ে দিলো। আমরা আরেকবার আলাদা হয়ে গেলাম।
বড় আপা এবার কথা বললো। একটু জোরেই। বললো, 'চল, আমরা হাত তুলে দোয়া করি'।
আমি বললাম, ‘দোয়া করবো কেনো? মা’র তো অসুখ করে নাই’।
বড় আপা বেশ বিরক্ত হলো বলে মনে হলো। চোখেমুখে তার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। বললো, ‘বড্ড কথা শিখেছিস! অসুখ হলেই খালি মানুষ দোয়া করে?’
বড় আপার কথায় ভরসা আছে। তাকে কোনোদিন মিথ্যে কথা বলতে দেখিনি। আজও যে মিথ্যে বলছেনা সেটা জানি। কিন্তু, তা-ও মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা জানতে পারছিনা, অথবা আমাকে জানানো হচ্ছেনা। কেনো জানাচ্ছে না কে জানে! তবুও বড় আপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মায়ের অনুপস্থিতিতে সে-ই আমাদের সব। তার আনুগত্য করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমাদের। আমার আলাভোলা চেহারা দেখে আপার সম্ভবত করুণা হলো। মুখভরা একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো বড় আপা। তার হাসিতে এতোক্ষণের গুমোট পরিবেশে মুহূর্তে প্রাণের হিল্লোল দোল খেলো যেন! আকাশ মেঘে ভর্তি, তবু মনে হচ্ছে চারদিক খুব হালকা। বড় আপার মুখের এই হাসিটা অনেককিছুর ইঙ্গিত দেয়। চিন্তায় পড়ে যাওয়ার মতো কোনোকিছু মা’র হয়নি। যদিও কিছু হয়ে থাকে, তা অবশ্যই ভালো কিছু। ভালো কিছুর সংবাদটা আপাই জানালো অবশ্য। বললো, ‘আমাদের ঘরে আরেকটা বাবু আসবে রে’।
বাবু আসার সংবাদে সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছে রুমু। সে জানতো আসমান থেকে আমাদের আনা হয়েছে। কিন্তু আজ তো ঘরের দরোজাই বন্ধ। আসমান থেকে নতুন বাবু কিভাবে আসবে? সে চোখেমুখে বিস্ময় ধরে রেখে আবার খেলায় মন দিলো। সম্ভবত বড় আপার সাবধান বাণী সে আজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে বলে স্থির করে ফেলেছে। মারুফাও চুপচাপ।
খানিক বাদে ঘরের ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। নবজাতকের কান্না! আমি প্রায় আঁতকে উঠেছি বলা চলে। বিস্ময় নিয়ে কান্নার অকুস্থলের দিকে তাকিয়ে আছে রুমু। সে বুঝতে পারছেনা ঘরের দরোজা বন্ধ থাকাবস্থায় আসমান থেকে কিভাবে বাবুটা টুপ করে ঘরে এসে পড়লো! আজ সম্ভবত তার বিস্মিত হবার দিন। মারুফাও তাকিয়ে আছে ঘরের দরোজার দিকে।
বয়স্ক মহিলাটা দরোজা খুলে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো। বড় আপাকে লক্ষ্য করে বললো, ‘মিনু, তোর বইন হইছে’।
আমি খেয়াল করলাম, আমাদের বোন হয়েছে শোনামাত্র আপার মুখ বিমর্ষ, গম্ভীর আর ভারি হয়ে গেলো। মনে হলো খুব অপ্রত্যাশিত কোন ব্যাপার ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের কোন প্রস্তুতি ছিলোনা।
বৃষ্টির থামাথামির কোন নামগন্ধ নেই। এরই মধ্যে কাজের পাওনা হিশেবে বয়স্ক ধাত্রী মহিলা কিছু চাল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে মাথার ওপর অর্ধ ছেঁড়া একটা ছাতা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমাদের নতুন অতিথি এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেলো। মা পাটিতে শুয়ে আছে। তার পাশে আগত নতুন মেহমান। রুমু পুতুল বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মারুফাও আরেকটু দূরে, বিছানো ছাটাইতে হাত-পা গুটিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমি আর বড় আপা বসে আছি মায়ের পাশে। মা’র মুখও বিষণ্ণ। আজকের বাইরের আকাশের মতো। আমরা অপেক্ষা করে আছি বাবার জন্যে। প্রতিদিনের মতো আজ দিনের বেলাতেও বাবা বাসায় নেই।
ভারি বর্ষণ একটু কমলো বটে, তবুও বাইরে গেলে গা ভিজে ছপছপ করবে। এরই মধ্যে, হুড়মুড় করে উঠোন ভেঙে বাবার আবির্ভাব হলো। বাবাকে খুব ভয় পাই আমরা। তার ভারি লাল লাল চোখ। শক্ত হাত। আমরা জানি, বাবার শক্ত হাতের কিল খেলেই আমাদের গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠে যায়। তাই, বাবার কাছে কখনোই কোন আদিখ্যেতা করার সাহস হয়নি। বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মা। এরপর বড় আপা। এরপর আমি। এরপর কে? সম্ভবত রুমু। মারুফা কি বাবাকে ভয় পায়? জানিনা।
এরপরের ঘটনা খুব নাটুকে। আমাদের নতুন আরেকটা বোন হয়েছে শুনে বাবা বাঘের মতো গর্জন শুরু করলো। আকাশে মেঘের গর্জনও বাবার গর্জনের নিচে চাপা পড়ে গেলো সেদিন। মুহূর্তে যে কি থেকে কি হলো বুঝে উঠতে পারিনি। সেদিন মা’কে আমি আবিষ্কার করেছি আমাদের উঠোনে। কাঁদায় মাখামাখি। মা উঠে দাঁড়াতে পারছেনা কোনোভাবে। বড় আপা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে ঘরের এক কোণে। ভয়ার্ত চোখমুখ নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে আমার দুটো বোন। রুমু আর মারুফা। নতুন যে এসেছিলো, সেও চিৎকার জুড়েছে। সে যে কেনো কান্না করছে তা আমি বুঝতে পারিনি।
আবারও ভারি বর্ষণ শুরু হয়েছে। সেই বর্ষণের মাঝে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে আমার মা। মা কি কাঁদছে? বৃষ্টির কারণে বুঝতে পারছিনা। তাকে খুব অসহায় আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি এই বৃষ্টির মধ্যেই উঠোনে নেমে পড়লাম। মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘ঘরে আসো মা’।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি তার বুকের সাথে লেপ্টে রইলাম। তার বুকে ভীষণ ঝড় উঠেছে। সেই ঝড় বাইরের ঝড়ের চাইতেও শক্তিশালী। মহাসাগরের বুকে মহা দূর্যোগের সময় যে ঝড় উঠে, সেই ঝড়ও মায়ের বুকের ঝড়ের কাছে নস্যি। মা আমাকে সেদিন একটা কথাই বললো। ‘তোর বাপের মতো হোস নে বাবা’।
[২]
আজও বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়ায় লন্ডভন্ড প্রকৃতি। আমি দাঁড়িয়ে আছি অপারেশান থিয়েটারের করিডোরে। ভিতরে আমার স্ত্রী ফাতিমা। প্রচন্ড প্রসব বেদনায় সে কাতর। তার চিৎকার আমার বুকটাকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। আজ আমাদের ঘরে নতুন আলো আসার দিন। ভয়, আশা আর আনন্দের ত্রিমুখী সংঘর্ষে আমি বিধ্বস্ত। বাইরের প্রকৃতির মতোই ছিন্নভিন্ন প্রায়। আমার মনে পড়ে যায় শৈশবের কথা। একদিন। এমন ঘন ঘোর বরষা। এবং আমার মা। আমি আর ভাবতে পারিনা কিছুই। আমার মনে পড়ে যায় আমার বড় আপার কথা যে বছর খানেক আগে মরণ জ্বরে মারা গেছে। সেদিন, সেই কালবৈশাখীর দিনে আপা বলেছিলো, ‘চল, আমরা দোয়া করি’। সেদিনও বৃষ্টি ছিলো। আচ্ছা, আপা কি জানতো বৃষ্টি সময় দোয়া করলে সেই দোয়া আল্লাহ কবুল করে? হয়তো জানতো। সেদিন কি আমি দোয়া করেছিলাম? মনে পড়েনা।
আমি হাত তুললাম আল্লাহর কাছে। বললাম, ‘পরওয়ারদেগার! আমার স্ত্রীকে ধৈর্য্য দিন। এই ভীষণ ব্যথা সইবার তাকে শক্তি দিন। আর, আমাকে কন্যা সন্তান দান করুন। আমি কন্যার বাবা হতে চাই’।
আজও বৃষ্টির কোন থামাথামি নেই যেন! আকাশে কালো মেঘের অবিরাম ছুটোছুটি। হঠাৎ মধুর এক কান্নার আওয়াজ! নতুন এক প্রাণের আবির্ভাবের সংকেত। আমার বুকের ভিতরে উথাল-পাতালা অবস্থা। কেমন আছে ফাতিমা? আর, নতুন যে এলো সে?
একজন নার্স ছুটে বেরিয়ে এলো অপারেশান থিয়েটার থেকে। তার মুখ উজ্জ্বল। সে হাসিমুখেই বললো, ‘আপনার মেয়ে হয়েছে’।
আমি যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম! আল্লাহ আমার দোয়া শুনেছেন? আমাকে কন্যার বাবা বানিয়েছেন? আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা। নার্স আরেক দৌঁড়ে বাবুটাকে নিয়ে এলো আমার কাছে। আমি ভালো করে দেখলাম তার চেহারা। অবিকল আমার মায়ের মতো। আমার মা, যে বুকের ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে আমার সামনে মারা গিয়েছিলো। আমার কোল আলো করে যেন আমার মা-ই ফিরে এসেছে। সেই মা, যে কাকভেজা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে, আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলেছিলো, ‘তোর বাপের মতো হোস নে বাবা’।
আমি চুমু খেলাম আমার ছোট্ট মায়ের কপালে। সে চোখ মিটমিট করে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ‘মা দেখো, আমি আমার বাবার মতোন হইনি’।

লেখকঃ আরিফ আজাদ

No comments

Post a Comment

Don't Miss
© all rights reserved.
Made with by Science Tech BD