Responsive Ad Slot

সর্বশেষ

latest

মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার ক্রমবিকাশ-০২

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ এবং নক্ষত্ররা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে । তার এই বিশ্বাসের কারণ ছিল একটি অতিন্দ্রীয় যুক্তি। পৃথিবীর অবস্থান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং বৃত্তাকার গতিই হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আরেক গ্রিক পণ্ডিত টলেমি এই ধারণাকে একটি পরিপূর্ণ মডেলে রূপ দান করেন। তাঁর গবেষণা সম্পর্কে তিনি আবেগসিক্ত ভাষায় বলেন, বৃত্তাকার পথে চলনশীল নক্ষত্রদের গতির কথা ভাবতে থাকলে আমার মনেই হয় না আমি এই পৃথিবীতে আছি।' টলেমির মডেলে আটটি ঘূর্ণায়মান গােলক পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছিল। এর প্রতিটি আগেরটি চেয়ে ক্রমান্বয়ে বড় ছিল, অনেকটা রুশদের নেস্টিং ডলের মতাে। এই গােলকদের কেন্দ্রে ছিল পৃথিবীর অবস্থান। সবচেয়ে বাইরের গােলকের পরে কী আছে তা কখনােই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তবে একে মানুষের পর্যবেক্ষণযােগ্য মহাবিশ্বের (Observable Universe) মধ্যেও গণ্য করা হয়নি। ফলে বাইরের গােলকটিই ছিল মহাবিশ্বের সীমানা বা ধারক । এই গােলকের মধ্যে নক্ষত্ররা স্থিরভাবে বসেছিল, ফলে গােলকটি আবর্তন করলেও নক্ষত্রদের পারস্পরিক অবস্থান একই থাকত এবং এরা দলবেঁধে একই সাথে পুরাে আকাশজুড়ে আবর্তন করত। চিত্র : টলেমির মডেল টলেমির মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং একে ঘিরে রাখা আইটি গোলক মহাকাশের সবগুলাে বস্তুকে ধারণ করে রেখেছিল গ্রহদের গােলক ছিল ভেতরের দিকে। এরা এদের নিজস্ব গােলকের মধ্যে নক্ষত্রদের মতাে স্থির ছিল না বরং গােলকের মধ্যেই এরা আবার ছােট ছােট বৃত্তাকার পথে চলত। এই বৃত্তাকার পথকে বলা হত মন্দবৃত্ত (Epicycle)। গ্রহরা গােলকের সাথে ঘূর্ণনের পাশাপাশি নিজেরাও গােলকের মধ্যে চলাচল করছে বলে পৃথিবী থেকে দেখতে এদের চলাচলের পথকে জটিল দেখাচ্ছে। এভাবে টলেমি আকাশে গ্রহদের দৃশ্যমান কক্ষপথকে প্যাচানাে দেখা যাচ্ছে কেন তার একটি ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেন। টলেমির মডেলের সাহায্যে আকাশের বস্তুদের অবস্থানের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল । কিন্তু এই অবস্থানগুলাের সঠিক পূর্বাভাস দিতে গিয়ে। মেনে নিতে হচ্ছিল যে চাদের কক্ষপথ একে কোনাে কোনাে সময় অন্য সময়ের চেয়ে পৃথিবীর দ্বিগুণ কাছে নিয়ে আসে । এটা সঠিক হলে কোনাে কোনাে সময় চাঁদকে অন্য সময়ের দ্বিগুণ বড় দেখানাের কথা ছিল। টলেমি তাঁর মডেলের এই খুঁত সম্পর্কে জানতেন। তবুও তাঁর মডেলটি সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল, যদিও সবাই তা মেনে নেয়নি । ধর্মগ্রন্থের সাথে মিলে যাওয়ায় খ্রিস্টানদের গির্জায়ও এই মডেলকে স্বাগত জানানাে হয়। গির্জার জন্য এই মডেলের সুবিধা ছিল, এতে স্থির গােলকদের বাইরে স্বর্গ ও নরকের জন্য যথেষ্ট জায়গা উপস্থিত ছিল। কিন্তু ১৫১৪ সালে পােলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস অন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। সম্ভবত গির্জাবিরােধী হিসেবে পরিচিত হবার ভয়ে শুরুতে তিনি এটি প্রকাশ করেন নাম গােপন রেখে । তিনি একটি বৈপ্লবিক মতামত প্রকাশ করলেন । তাঁর মতে, মহাকাশের সব কিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে-এটা সত্য নয়। বরং সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির আছে এবং পৃথিবী ও গ্রহরা সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। টলেমির। মডেলের মতােই এটিও কিছুটা সফল হলাে, কিন্তু পর্যবেক্ষণের সাথে পুরােপুরি মিলল না। এটি টলেমির মডেলের চেয়ে অনেক সরল ছিল বলে একে মেনে নেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু এক শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এটি কোথাও গুরুত্ব পেল না । এরপর দুজন জ্যোতির্বিদ-জার্মানির জোহানেস কেপলার ও ইতালির গ্যালিলিও গালিলেই প্রকাশ্যে কোপার্নিকান তত্ত্বের পক্ষে অবস্থান নেন। | ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও তার কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের সাহায্যে রাতের আকাশ দেখা শুরু করেন । তিনি বৃহস্পতির (Jupiter) দিকে তাকিয়ে দেখেন, এর চারপাশে কিছু ছােট ছােট উপগ্রহ একে প্রদক্ষিণ করছে। এর অর্থ হচেছ অ্যারিস্টটল ও টলেমিদের চিন্তা সঠিক নয়-সব কিছুকে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে, এমন কোনাে কথা নেই। একই সময়ে কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি উন্নত করেন। নতুন তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, গ্রহরা বৃত্তাকার পথে নয়, চলছে উপবৃত্তাকার পথে । এই পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ মিলে গেল। এ ছিল টলেমির মডেলের কফিনে শেষ পেরেক।

Monday, 4 November 2019

/ by Admin
 অ্যারিস্টটল মনে করতেন, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ এবং নক্ষত্ররা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে । তার এই বিশ্বাসের কারণ ছিল একটি অতিন্দ্রীয় যুক্তি। পৃথিবীর অবস্থান মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং বৃত্তাকার গতিই হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আরেক গ্রিক পণ্ডিত টলেমি এই ধারণাকে একটি পরিপূর্ণ মডেলে রূপ দান করেন। তাঁর গবেষণা সম্পর্কে তিনি আবেগসিক্ত ভাষায় বলেন, বৃত্তাকার পথে চলনশীল নক্ষত্রদের গতির কথা ভাবতে থাকলে আমার মনেই হয় না আমি এই পৃথিবীতে আছি।'
টলেমির মডেলে আটটি ঘূর্ণায়মান গােলক পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছিল। এর প্রতিটি আগেরটি চেয়ে ক্রমান্বয়ে বড় ছিল, অনেকটা রুশদের নেস্টিং ডলের মতাে। এই গােলকদের কেন্দ্রে ছিল পৃথিবীর অবস্থান। সবচেয়ে বাইরের গােলকের পরে কী আছে তা কখনােই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তবে একে মানুষের পর্যবেক্ষণযােগ্য মহাবিশ্বের (Observable Universe) মধ্যেও গণ্য করা হয়নি। ফলে বাইরের গােলকটিই ছিল মহাবিশ্বের সীমানা বা ধারক । এই গােলকের মধ্যে নক্ষত্ররা স্থিরভাবে বসেছিল, ফলে গােলকটি আবর্তন করলেও নক্ষত্রদের পারস্পরিক অবস্থান একই থাকত এবং এরা দলবেঁধে একই সাথে পুরাে আকাশজুড়ে আবর্তন করত।

টলেমির মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং একে ঘিরে রাখা আটটি গোলক মহাকাশের সবগুলাে বস্তুকে ধারণ করে রেখেছিল।

গ্রহদের গােলক ছিল ভেতরের দিকে। এরা এদের নিজস্ব গােলকের মধ্যে নক্ষত্রদের মতাে স্থির ছিল না বরং গােলকের মধ্যেই এরা আবার ছােট ছােট বৃত্তাকার পথে চলত। এই বৃত্তাকার পথকে বলা হত মন্দবৃত্ত (Epicycle)। গ্রহরা গােলকের সাথে ঘূর্ণনের পাশাপাশি নিজেরাও গােলকের মধ্যে চলাচল করছে বলে পৃথিবী থেকে দেখতে এদের চলাচলের পথকে জটিল দেখাচ্ছে। এভাবে টলেমি আকাশে গ্রহদের দৃশ্যমান কক্ষপথকে প্যাচানাে দেখা যাচ্ছে কেন? তার একটি ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেন।

টলেমির মডেলের সাহায্যে আকাশের বস্তুদের অবস্থানের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল । কিন্তু এই অবস্থানগুলাের সঠিক পূর্বাভাস দিতে গিয়ে মেনে নিতে হচ্ছিল যে চাদের কক্ষপথ একে কোনাে কোনাে সময় অন্য সময়ের চেয়ে পৃথিবীর দ্বিগুণ কাছে নিয়ে আসে। এটা সঠিক হলে কোনাে কোনাে সময় চাঁদকে অন্য সময়ের দ্বিগুণ বড় দেখানাের কথা ছিল। টলেমি তাঁর মডেলের এই খুঁত সম্পর্কে জানতেন। তবুও তাঁর মডেলটি সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল, যদিও সবাই তা মেনে নেয়নি । ধর্মগ্রন্থের সাথে মিলে যাওয়ায় খ্রিস্টানদের গির্জায়ও এই মডেলকে স্বাগত জানানাে হয়। গির্জার জন্য এই মডেলের সুবিধা ছিল, এতে স্থির গােলকদের বাইরে স্বর্গ ও নরকের জন্য যথেষ্ট জায়গা উপস্থিত ছিল।

কিন্তু ১৫১৪ সালে পােলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস অন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। সম্ভবত গির্জাবিরােধী হিসেবে পরিচিত হবার ভয়ে শুরুতে তিনি এটি প্রকাশ করেন নাম গােপন রেখে । তিনি একটি বৈপ্লবিক মতামত প্রকাশ করলেন । তাঁর মতে, মহাকাশের সব কিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে-এটা সত্য নয়। বরং সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির আছে এবং পৃথিবী ও গ্রহরা সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। টলেমির। মডেলের মতােই এটিও কিছুটা সফল হলাে, কিন্তু পর্যবেক্ষণের সাথে পুরােপুরি মিলল না। এটি টলেমির মডেলের চেয়ে অনেক সরল ছিল বলে একে মেনে নেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু এক শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এটি কোথাও গুরুত্ব পেল না । এরপর দুজন জ্যোতির্বিদ-জার্মানির জোহানেস কেপলার ও ইতালির গ্যালিলিও গালিলেই প্রকাশ্যে কোপার্নিকান তত্ত্বের পক্ষে অবস্থান নেন।

১৬০৯ সালে গ্যালিলিও তার কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের সাহায্যে রাতের আকাশ দেখা শুরু করেন । তিনি বৃহস্পতির (Jupiter) দিকে তাকিয়ে দেখেন, এর চারপাশে কিছু ছােট ছােট উপগ্রহ একে প্রদক্ষিণ করছে। এর অর্থ হচেছ অ্যারিস্টটল ও টলেমিদের চিন্তা সঠিক নয়-সব কিছুকে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে, এমন কোনাে কথা নেই। একই সময়ে কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি উন্নত করেন। নতুন তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, গ্রহরা বৃত্তাকার পথে নয়, চলছে উপবৃত্তাকার পথে । এই পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ মিলে গেল। এ ছিল টলেমির মডেলের কফিনে শেষ পেরেক।

No comments

Post a Comment

Don't Miss
© all rights reserved.
Made with by Science Tech BD