আরেকটু স্পষ্ট করি । মনে করুন, কেউ ট্রেনের মধ্যে একটি পিং-পং বল উঠা-নামা করাচ্ছে। বলটি এক সেকেন্ড পর পর টেবিলের একই বিন্দুতে ধাক্কা খাচ্ছে । এই লােকটির কাছে বলের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কার স্থান একই থাকছে। কিন্তু রেললাইনের পাশে দাঁড়ানাে কারাে কাছে মনে হবে, বলের দুটি ধাক্কা ৪০ মিটার দূরে দূরে হচ্ছে, কারণ ততক্ষণে ট্রেন এই পরিমাণ পথ অতিক্রম করেছে।
নিউটনের মতে দুই পর্যবেক্ষকেরই নিজেকে স্থির মনে করার সমান অধিকার আছে। তার মানে দুটো মতই সমানভাবে গ্রহণযােগ্য । অ্যারিস্টটলের বিশ্বাসের বিপরীতে কোনাে একটির ওপর অন্য কোনােটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। ট্রেনে ও রেললাইনের পাশে থাকা ব্যক্তির জন্য বিভিন্ন ঘটনার দৃশ্যমান অবস্থান ও তাদের মধ্যকার দূরত্বের হিসাব ভিন্ন ভিন্ন হবে। একজনের তুলনায় আরেকজনের পর্যবেক্ষণকে ভালাে বলার পেছনে কোনাে যুক্তি নেই।
পরম অবস্থান বা কথিত পরম স্থান নামক জিনিসটির অভাব নিউটনকে চিন্তিত করে তােলে, কারণ এটা তাঁর পরম ঈশ্বরের ধারণার সাথে খাপ খাচ্ছিল না। এবং তিনি পরম স্থানের অভাবকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন, যদিও তাঁর নিজেই সূত্রই দিয়েছিল তার বিপরীত ইঙ্গিত। এই অযৌক্তিক বিশ্বাসের জন্য অনেকেই তাঁর তীব্র সমালােচনা করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিলেন দার্শনিক বিশপ বার্কলে। তিনি আবার বিশ্বাস করতেন যে সব জড় বস্তু এবং স্থান ও কাল আসলে শুধুই মস্তিষ্কের কল্পনা ।
স্থানের আপেক্ষিকতা একটি বস্তুর অতিক্রান্ত দূরত্ব এবং চলাচলের পথ ভিন্ন ভিন্ন দর্শকের কাছে আলাদা মনে হতে পারে
বিখ্যাত ড. জনসন বার্কলের মন্তব্য শুনে বড় একটি পাথরের মধ্যে লাথি মেরে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি এই কথাকে এইভাবে খণ্ডন করছি। অ্যারিস্টটল ও নিউটন দুজনেই সময়কে পরম করতেন। অর্থাৎ তাঁদের বিশ্বাস ছিল, ভালাে একটি ঘড়ির সাহায্যে কেউ দুটো ঘটনার মধ্যবর্তী সময় সঠিকভাবে মাপতে পারবেন এবং যে কারাে মাপা সময় একই পাওয়া যাবে । পরম স্থানের ধারণা নিউটনের সূত্রে ভুল মনে হলেও পরম সময়ের ব্যাপারে এতে কোনাে রকম অসংগতি ছিল না। অধিকাংশ মানুষও একেই স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নেবে । কিন্তু বিংশ শতকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, স্থান এবং সময় দুটো সম্পর্কেই প্রচলিত ধারণা বদলে ফেলতে হবে।
আমরা পরে দেখব, তাঁরা আবিষ্কার করলেন যে বিভিন্ন ঘটনা যেমন পিংপং বল কোথায় ধাক্কা খাচ্ছে তার মধ্যবর্তী সময়ের ব্যাবধান নির্ভর করছে পর্যবেক্ষকের ওপর। তারা আরও আবিষ্কার করলেন, সময় স্থান থেকে একেবারে আলাদা ও স্বতন্ত্র নয়। আলাের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞান এই উপলব্ধির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। একে আমাদের অভিজ্ঞতার বিপরীত মনে হতে পারে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ধীর বস্তু যেমন আপেল বা গ্রহদের বেলায় আমাদের সহজাত ধারণা বেশ ভালাে কাজ করলেও আলাের সমান বা কাছাকাছি বেগে চলন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে তা একেবারেই অকেজো ।
নােট-
১. সময়ের সাথে বেগের এই পরিবর্তনকেই আমরা ত্বরণ বলি। একটু পরেই এই
ধারণা আবার কাজে লাগবে।
২. বলটি হলাে বস্তুর ওজন। আমরা সাধারণত যাকে ওজন বলি, বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় ভর। একটি বস্তুতে মােট কতটুকু পদার্থ আছে সেটাই হলাে তার ভর। আর ওজন হলাে এক প্রকার বল। পৃথিবী কোনাে বস্তুকে যে বলে নিজের দিকে টানে সেটাই হল তার ওজন। গাণিতিকভাবে এর মান বের করা হয় ভরের সাথে পৃথিবীর অভিকর্ষজনিত ত্বরণ (যার মান প্রতি বর্গ সেকেন্ডে গড়ে ৯.৮১ মিটার) গুণ করে। সাধারণত পৃথিবীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও ওজন কথাটি অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ বা নক্ষত্রের বেলায়ও ব্যবহৃত হতে পারে।


No comments
Post a Comment