একটি বিশাল ভরের নক্ষত্র গুটিয়ে ব্ল্যাক হােল তৈরি হবার সময় কী দেখা যাবে? এটা জানতে হলে মাথায় রাখতে হবে যে আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে পরম সময় বলতে কিছু নেই। অন্য কথায়, প্রত্যেক দর্শক তার নিজের মতাে করে সময় মাপবেন। নক্ষত্রের পৃষ্ঠে অবস্থান করলে যে সময় পাওয়া যাবে, দূরে অবস্থান করা কেউ তার চেয়ে ভিন্ন সময় পাবেন । এর কারণ হলাে, নক্ষত্রের পৃষ্ঠে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র বেশি শক্তিশালী।
এখন ধরুন, একটি নক্ষত্র ভেতরের দিকে গুটিয়ে যাওয়ার সময় এক অকুতােভয় নভােচারী এর পৃষ্ঠে বসে আছেন। কোনাে একসময় হয়তাে। তাঁর ঘড়িতে দেখা গেল ১১:০০টা বাজে। ঠিক এই সময় নক্ষত্রটি সঙ্কট ব্যাসার্ধ° পার হয়ে আরও ছােট হয়ে গেল। এখন এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতটা শক্তিশালী হল যে কিছুই আর বের হতে পারবে না। এখন ধরুন, তাকে বলা হয়েছিল যে ঘড়ি দেখে প্রতি সেকেন্ডে একটি করে সঙ্কেত পাঠাতে হবে । সঙ্কেত গ্রহণ করার জন্য একটু দূরে একটি মহাকাশযান নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে । তিনি যখন সঙ্কেত পাঠানাে শুরু করেন তখন সময় ১০:৫৯:৫৮। অর্থাৎ, ১১:০০টা বাজতে আর দুই সেকেন্ড বাকি। এখন মহাকাশযানে বসে তাঁর সাথীরা কী দেখতে পাবেন?
এর আগে আমরা থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে দেখেছিলাম মহাকর্ষের কারণে রকেটের ভেতরে সময় ধীরে চলে । মহাকর্ষ শক্তিশালী হলে এই প্রভাবও হয় বেশি। নক্ষত্রের পৃষ্ঠে থাকা নভােচারীর কাছে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মান তাঁর সাথীদের চেয়ে শক্তিশালী। এর ফলে তাঁর কাছে যেটা এক সেকেন্ড, সেটাই তাঁর সাথীদের কাছে আরও বেশি সময় মনে হবে । নক্ষত্র গুটিয়ে যাবার সময় তিনিও যখন ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছেন, মহাকর্ষ ক্রমেই তত শক্তিশালী হচ্ছে। এর ফলে মহাকাশযানের যাত্রীদের কাছে তাঁর পাঠানাে বিভিন্ন সঙ্কেতের মধ্যবর্তী সময় ক্রমেই লম্বা মনে হতে থাকবে । সময়ের এই প্রসারণ ১০:৫৯:৫৯ এর আগে খুব ক্ষুদ্র হবে। তাই মহাকাশযানের যাত্রীদেরকে ১০:৫৯:৫৮ এবং ১০:৫৯:৫৯ সময়ে পাঠানাে সঙ্কেত দুটি পেতে এক সেকেন্ডের চেয়ে সামান্য বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ১১:০০টার সময় পাঠানাে সঙ্কেত পেতে তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে চিরকাল।
১০:৫৯:৫৯ ও ১১:০০টার মধ্যবর্তী সময়ে নক্ষত্রের পৃষ্ঠে যা কিছু ঘটবে তা মহাকাশযান থেকে দেখতে অসীম সময়ের প্রয়ােজন হবে। ১১:০০টা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নভােচারীর পাঠানাের সঙ্কেতের মতােই আলাের তরঙ্গের পর্যায়ক্রমিক খাঁজ ও চূড়ার পার্থক্য লম্বা হতে থাকবে। আমরা জানি, প্রতি সেকেন্ডে সৃষ্ট চূড়া ও খাঁজের সংখ্যাকেই আলাের কম্পাঙ্ক বলে। অতএব, মহাকাশযানের দর্শকদের কাছে নক্ষত্রের আলাের কম্পাঙ্ক কমে যেতে থাকবে । এই আলাে তাই ধীরে ধীরে লাল (এবং ঝাপসা) হতে থাকবে। একসময় নক্ষত্রটি এত অনুজ্জ্বল হয়ে যাবে যে একে আর যান থেকে দেখা যাবে না। সামনে শুধুই পড়ে থাকবে মহাশূন্যের এক কালাে গহ্বর । তবে যানের ওপর এর মহাকর্ষীয় টান চলতেই থাকবে এবং যানটিও একে ঘিরে চলতে থাকবে ।
এই দৃশ্য অবশ্য পুরােপুরি বাস্তবসম্মত নয়। এতে একটু সমস্যা আছে । নক্ষত্র থেকে দূরের দিকে মহাকর্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আমাদের নির্ভীক নভােচারীর পায়ের কাছে মহাকর্ষ সব সময় তার মাথার চেয়ে বেশি হবে । মহাকর্ষের এই পার্থক্য তাকে সেমাইয়ের মতাে টেনে লম্বা করে দেবে। এর ফলে নক্ষত্রটি সঙ্কট ব্যাসার্ধে পৌছে ঘটনা দিগন্ত তৈরি করার আগেই তিনি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। অবশ্য আমাদের বিশ্বাস, মহাবিশ্বে আরও বড় বড় বস্তুও আছে। যেমন গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলেও মহাকর্ষীয় সঙ্কোচনের ফলে ব্ল্যাকহোেল তৈরি হতে পারে। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই এ রকম একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহােল আছে । এ ধরনের কোনাে ব্ল্যাকহোেল অভিযানে গেলে নভােচারীকে আগের মতাে বিপদে পড়তে হবে।
সঙ্কট ব্যাসার্ধে পৌছেও তাঁর বিশেষ কোনাে অনুভূতি হবে না। তিনি নিজের অজান্তেই পয়েন্ট অব নাে রিটার্ন (point of no return, অর্থাৎ যা থেকে আর ফিরে আসা যাবে না) পার হয়ে যাবেন । অবশ্য বাইরে থেকে দেখতে আগের মতােই তাঁর পাঠানাে সঙ্কেত দীর্ঘস্থায়ী হতে হতে একসময় হারিয়ে যাবে । আর নভােচারীর ঘড়ি অনুসারে আরও কয়েক ঘণ্টা পরে ঠিকই বিপদ দেখা দেবে । মহাকর্ষের ফলে সঙ্কোচন অব্যাহত থাকায় একসময় তার মাথা ও পায়ের কাছে মহাকর্ষীয় বলের পার্থক্য এত বেশি হবে যে তিনি আগের মতােই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন ।
চিত্র : মহাকর্ষীয় টান
দূরত্বের সাথে সাথে মহাকর্ষ দুর্বল হতে থাকে বলে পৃথিবীর আকর্ষণ আপনার পায়ের চেয়ে মাথায় মহাকর্ষীয় টান কম! এখানে পার্থক্য এক মিটার বা তার কাছাকাছি, তাই এখানে মহাকর্ষের পার্থক্য খুব সামান্য বলে তা আত্রা টের পাই না। কিন্তু ব্ল্যাক হােলের কাছে থাকা একজন নভােচারী ঠিকই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বেন।
No comments
Post a Comment