মিল্কিওয়ের বাইরে আরও গ্যালাক্সির উপস্থিতি প্রমাণ করার পরের বছরগুলােতে হাবল এদের বর্ণালি দেখে দেখে দূরত্ব বের করার কাজে লেগে গেলেন। সেই সময় বেশির ভাগ মানুষ মনে করত গ্যালাক্সিরা এলােমেলােভাবে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করবে। সে জন্য হাবলও আশা করেছিলেন, তিনি গ্যালাক্সিদের লাল সরণ (তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল দিকে সরে যাওয়া) যত দেখবেন নীল সরণও সেই পরিমাণ দেখবেন। কাজেই বেশির ভাগ গ্যালাক্সির বর্ণালির সরণ লালের দিকে দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। এদের প্রায় সবাই আমাদের থেকে দূরে সরছে! ১৯২৯ সালে হাবল এর চেয়েও অবাক করা তথ্য প্রকাশ করেন। গ্যালাক্সিদের লাল সরণও এলােমেলােভাবে হচ্ছে না, বরং এটা আমাদের থেকে তাদের দূরত্বের সরাসরি সমানুপাতিক। এর অর্থ হচ্ছে, একটি গ্যালাক্সি যত দূরে অবস্থিত, সেটি তত দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ আগের ধারণা ভুল, মহাবিশ্বের আকার স্থির বা অপরিবর্তনশীল নয়। এটি আসলে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন গ্যালাক্সির মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়ছে ।
চিত্র : ডপলার প্রভাব একটি তরঙ্গ উৎস দর্শকের দিকে এগিয়ে গেলে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছােট হয়ে যায়, আর দর্শক থেকে দূরে সরলে হয়ে যায় বড় । এটিই ডপলার প্রভাব।
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ আবিষ্কার বিংশ শতকের বিরাট এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব । অতীতে ফিরে তাকালে একটু অবাকই হতে হয়। আগে কেউ কেন এভাবে চিন্তা করেনি। নিউটনসহ অন্যদের বােঝা উচিত ছিল একটি স্থির মহাবিশ্ব হবে অস্থিতিশীল । কারণ সবগুলাে নক্ষত্র ও ছায়াপথ মিলিতভাবে একে অপরের ওপর যে মহাকর্ষীয় টান প্রয়ােগ করবে তাকে ঠেকানাের তাে কেউ নেই। কাজেই কোনাে একসময় যদি মহাবিশ্ব স্থির থেকেও থাকে, তবু এর পক্ষে স্থির হয়ে বসে থাকা অসম্ভব ছিল। কারণ সবগুলাে নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির পারস্পরিক আকর্ষণের ফলে মহাবিশ্ব পরক্ষণেই সঙ্কুচিত হতে শুরু করত। | এমনকি মহাবিশ্ব যদি মােটামুটি ধীরগতিতেও প্রসারিত হতাে, তবু মহাকর্ষের প্রভাবে একসময় এর প্রসারণ থেমে যেত এবং অবশেষে শুরু হতাে সঙ্কোচন। কিন্তু যদি মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট হারের চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হয়, তাহলে মহাকর্ষ কখনােই এই প্রসারণ থামানাের মতাে শক্তিশালী হতে পারবে না। এর ফলে এটি চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে । পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে রকেট নিক্ষেপ করলে যা ঘটে তার সাথে এর কিছুটা মিল আছে। রকেটের গতি যদি একটু কম হয় অভিকর্ষ একে থামিয়ে দেবে এবং এটি নিচে পড়ে যাবে। কিন্তু রকেটের গতি যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হয় (সেকেন্ডে প্রায় সাত মাইল), তাহলে একে থামানাের শক্তি অভিকর্ষের হবে না। এর ফলে এটি পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে ।
উনিশ, আঠারাে বা এমনকি সতেরাে শতকের শেষের দিকেই নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকে মহাবিশ্বের এই আচরণ অনুমান করা যেত। কিন্তু স্থির মহাবিশ্বের ধারণা সবার মনে এতটা বদ্ধমূল হয়ে আসন গেড়েছিল যে এই ধারণা টিকে থাকল বিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত । এমনকি আইনস্টাইনেরও স্থির মহাবিশ্বের ওপর অগাধ বিশ্বাস ছিল । ১৯১৫ সালে সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করার সময় নিজের তত্ত্বকে সেই বিশ্বাসের সাথে মিলানাের জন্য তিনি কিছুটা গোঁজামিলের আশ্রয় নেন। তিনি তার সমীকরণে মহাজাগতিক ধ্রুবক (Cosmological constant) নামে একটি রাশি আমদানি করেন । নতুন এই মহাজাগতিক ধ্রুবকের প্রতিক্রিয়া ছিল মহাকর্ষের বিপরীত । অন্যান্য বলের মতাে এই বলের জন্য কোনাে উৎসের প্রয়ােজন নেই, বরং এটি স্থান-কালেরই পরতে পরতে মিশে আছে। নতুন এই বলের প্রভাবে স্থান- কাল নিজে থেকেই প্রসারিত হবার প্রবণতা লাভ করে। মহাজাগতিক ধ্রুবক যােগ করে আইনস্টাইন এই প্রবণতার শক্তিকে ভারসাম্যে নিয়ে আসেন। তিনি দেখলেন যে তাঁর পক্ষে মহাবিশ্বের সকল পদার্থের পারস্পরিক আকর্ষণকে ব্যালেন্স করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে পাওয়া গেল স্থির মহাবিশ্ব । কিন্তু পরে তিনি মহাজাগতিক ধ্রুবকটি প্রত্যাহার করেন এবং একে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে অভিহিত করেন ।
একটু পরই আমরা দেখব, আসলে এটি যােগ করে তিনি সম্ভবত ঠিক কাজটিই করেছেন। কিন্তু আইনস্টাইন হতাশ হয়েছিলেন এ জন্য যে তিনি তাঁর বিশ্বাস ধরে রাখতে গিয়ে তাঁর তত্ত্বের (যা বলছিল মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে) ইঙ্গিতটিও এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একজন মানুষ সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের ইঙ্গিতকে ঠিকই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। যখন আইনস্টাইন ও অন্যরা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বের গতিশীল মহাবিশ্বের ইঙ্গিত এড়ানাের উপায় খুঁজছিলেন, সেই সময়েই রুশ গণিত ও পদার্থবিদ অ্যালেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান সেই গতিশীলতার ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে নেমে পড়লেন।
No comments
Post a Comment